রাজনীতিতে কোনঠাসা জামায়াত ইসলামী মাঠের প্রকাশ্য অবস্থান জানান দিতে এবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা এবং প্রগতিশীল ঘরনার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় সংগঠনটির কর্মসূচী বাস্তবায়নের কৌশলে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।
ইতিমধ্যে কৌশলের অংশ হিসেবে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে জেলা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুফতি মাওলানা হাবিব উল্লাহ রচিত একটি গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব। যে অনুষ্ঠানটিতে জামায়াত ঘরনার আলেম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবী ছাড়াও শিবিরের সাবেক দুর্ধর্ষ ক্যাডারসহ ছাত্র সংগঠনটির জেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন সাবেক-বর্তমান সভাপতি এবং প্রথম সারির নেতাকর্মিরা উপস্থিত ছিলেন।
মাঠের রাজনীতিতে প্রকাশ্য তৎপরতার চালানোর কৌশলী এ অনুষ্ঠানে ছত্রছায়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামাল হোসেন এবং কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ফজলুল করিম চৌধুরীকে। এসব প্রগতিশীল ঘরনার নেতা ও শিক্ষাবিদকে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে রাখা হয়েছে মূলত আইন শৃংখলা বাহিনী এবং প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে। যাতে করে জামায়াত নেতার গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসবটি নির্বিঘেœ সম্পাদন করা যায়।
গত ১১ জুলাই কক্সবাজার প্রেসক্লাবের মত প্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠানে মাওলানা হাবিব উল্লাহকে কথিত ‘গবেষক, লেখক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষককের’ পরিচয় দিয়ে ‘গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানটি’ আয়োজন করা হলেও ‘জামায়াত নেতার সাংগঠনিক’ পরিচয় সু-কৌশলে এড়ানো হয়েছে। অথচ ৩ দিন পরই গত ১৫ জুলাই জেলা জামায়াতের দায়িত্বশীল সভায় জেলা আমীর মোস্তাফিজুর রহমান সৌদি আরবে ওমরা পালন করতে যাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত আমীর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ‘ অধ্যাপক মুফতি মাওলানা হাবিব উল্লাহকে’।
অনুষ্ঠানে জামায়াত কৌশলগত দিক থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে সাধুতারও ভাব নিয়েছে। গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তা হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহবুবর রহমান।
এ নিয়ে কক্সবাজারের প্রগতিশীল ঘরনার নানা মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
জামায়াতের কৌশলগত এসব কর্মসূচীতে প্রগতিশীল ঘরানার নেতা ও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করছে কেউ জেনে, আবার কেউ না জেনে; কেউবা কর্মসূচীর বস্তুগত বিষয়গুলো গভীরভাবে অনুধাবন না করে। মূলত প্রগতিশীল ঘরনার নেতা ও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচী বাস্তবায়ন এবং মাঠের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে আসতে আইন শৃংখলা বাহিনী ও প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করাই জামায়াতের গোপন রাজনৈতিক মিশন। এতে প্রগতিশীল ঘরনার নেতা ও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের গ্রহণযোগ্যতাকেও সামাজিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার রাজনৈতিক সুবিধাটা সংগঠনটি নিতে পারবে।
মাঠের প্রকাশ্য রাজনীতিতে জামায়াত নিজেদের অবস্থান জানান দিতে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের আড়ালে হাতে নিয়েছে নানা কর্মসূচী। এসব কর্মসূচীতে জড়ো করা হচ্ছে জামায়াত শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডার এবং জেলা পর্যায়ের প্রথম সারির সাবেক নেতাকর্মিদের।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের কেন্দ্রিয় নেতা ফাঁসি এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংগঠন হিসেবে অপরাধের অভিযুক্ত হয়ে নিষিদ্ধ হওয়ার আশংকায় মনোবলে চির ধরে জামায়াতের নেতাকর্মিদের। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মিরা মনোবল হারিয়ে এক প্রকার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রভাব পড়ে তৃণমূলে সংগঠনটির প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখা নিয়ে। এসব কারণে বিরূপ পরিস্থিতিতে জামায়াত শিবিব পড়ে অস্থিত্ব সংকটে।
এতে তৃণমূলের নেতাকর্মিদের মনোবলহীনতা এবং দূর্বল সাংগঠনিক অবস্থান নিয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা দুরুহ দেখে মাঠের প্রকাশ্য রাজনীতিতে অবস্থান জানান দিতে জামায়াত ধুরন্ধর কৌশলেরই অংশ নিয়েছে। এসব কৌশলের অংশ হিসেবে সংগঠনটি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নামে মাঠ পর্যায়ে পালন করছে নানা কর্মসূচী।
মূলত: সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে তৃণমূলের নেতাকর্মিদের মনোবল চাঙ্গা নাশকতার পরিকল্পনার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই জামায়াত শিবিরের উদ্দ্যেশ। এ লক্ষ্যে মাঠের রাজনীতিতে প্রকাশ্য অবস্থানটা জানান দেয়াটাই আপতত সংগঠনটির কৌশলগত কর্মসূচী। এতে ছত্রছায়া হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং প্রগতিশীল ঘরনার প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিদের।
জামায়াত নেতার গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, মাওলানা হাবিব উল্লাহকে এলাকার প্রতিবেশীর পাশাপাশি কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল ( মাস্টার্স ) মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষক হিসেবেই চিনি। বিগত ২০০ বছরে কক্সবাজারের জন্মজাত ‘আলেম-ওলামা ও মাশায়েখদের’ জীবনী সম্বলিত তার রচিত একটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানেই অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
“ মূলত মাওলানা হাবিব উল্লাহকে একটি শিক্ষক হিসেবেই জানি। তার রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে আমার জানা নেই। তাকে কখনো জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশ নিতেও দেখিনি। তাছাড়া অনুষ্ঠানে জামায়াত শিবিরের দূর্ধর্ষ ক্যাডারসহ সংগঠনটির নেতাকর্মিদের অংশগ্রহনের বিষয়টি সম্পর্কেও আমি জানতাম না। ”
তবে মাওলানা হাবিব উল্লাহ এর জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকলে গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন না বলে মন্তব্য করে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কামাল।
জামায়াত নেতা হিসেবে নয়, একজন মাওলানা ও সাবেক শিক্ষককের রচিত গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান জেনেই জামায়াতের কৌশলগত এ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম ফজলুল করিম চৌধুরী।
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবিদার এ অধ্যক্ষ বলেন, কক্সবাজারের জন্মজাত গত ২০০ বছরের বিদ্বগ্ধ আলেম-ওলামা ও মাশায়েখদের জীবনী সম্বলিত একটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের কথা শুনেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি। তাছাড়া অনুষ্ঠানে কোন ধরণের রাজনৈতিক আলাপ আলোচনাও উঠে আসেনি।
তাই এ ধরণের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনা এবং প্রতিক্রিয়া দেখানো মূলত ভাল দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সরকারি কলেজের এ অধ্যক্ষ।
জামায়াত নেতার গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সরকারের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়া হয়েছে বলে প্রশ্ন করা হলে ফজলুল করিম বলেন, এ ধরণের দাবি সত্য নয়। জামায়াতার নেতার নয়, একজন মাওলানা ও শিক্ষকের গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানেই অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছি।
এটিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা উচিত নয় বলে মন্তব্য কক্সবাজার সরকারি কলেজের এ অধ্যক্ষের।
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল মোস্তফার সঙ্গে কথা হলে ঘটনাটি খুবই দু:খজনক বলে মন্তব্য করেন।
সিরাজুল বলেন, জামায়াত ইসলামী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী তো বটেই; দেশ ও জাতির শত্রু। মুক্তিযুদ্ধে অপরাধ সংগঠনের দায়ে সংগঠনটি অপরাধী ও অভিযুক্ত। তাই জামায়াতের সঙ্গে জড়িতরাও দেশ ও জাতির শত্রু।
অন্যদিকে যারা জেনে হোক বা না জেনে হোক জামায়াতের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে তারাও সমাজের জন্য শুভকর মানুষ নয়।
তাদেরকে জামায়াতের পৃষ্টপোষক হিসেবে ‘নব্য রাজাকার’ স্বীকৃতি দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের এ নেতা।
সিরাজুল বলেন, দলীয় কাঠামোর বাইরে অন্য যে কোন সংগঠনের অনুষ্ঠান বা কর্মসূচীতে অংশগ্রহনের ব্যাপারে দলের নেতাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেয়া হবে।
Copyright @ 2021
Development by: webnewsdesign.com